হজ্ব ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। এটি প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার ফরজ ইবাদত, যা হিজরি বর্ষপঞ্জির জিলহজ মাসে পবিত্র কাবা শরিফ, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় নির্দিষ্ট নিয়মে সম্পাদন করতে হয়।
হজের ফরজ তিনটি:
ইহরাম বাঁধা – হজ পালনের নিয়ত করে ইহরাম পরিধান করা।
আরাফাতে অবস্থান – ৯ই জিলহজ দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান।
তাওয়াফে জিয়ারত – ১০ই জিলহজ বা তার পরে কাবা শরিফে তাওয়াফ করা।
হজের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব:
আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ।
আত্মশুদ্ধি ও গোনাহ মাফের সুযোগ।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ।
ধৈর্য, ত্যাগ ও সংযমের মহড়া।
কুরবানি
কুরবানি হল নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট পশু জবাই করার ইবাদত। এটি মূলত ঈদুল আজহার (১০, ১১, ১২ জিলহজ) দিনে পালন করা হয়।
কুরবানির বিধান:
কুরবানি ওয়াজিব মুসলমানদের ওপর, যদি তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয় (অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়)।
পশু হতে হবে নির্দিষ্ট বয়স ও স্বাস্থ্যসম্মত:
ছাগল/ভেড়া: ১ বছর বা বেশি বয়স।
গরু/উট: যথাক্রমে ২ ও ৫ বছর বয়সী।
কুরবানির শিক্ষা ও তাৎপর্য:
ইব্রাহিম (আ.) এর ত্যাগ ও আনুগত্যের স্মরণ।
আল্লাহর প্রতি খাঁটি নিবেদন।
গরিব-দুঃখীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করা।
আত্মা ও প্রবৃত্তির কোরবানি শেখা।
হজ ও কুরবানির পারস্পরিক সম্পর্ক
উভয়ের মূল শিক্ষা: আত্মসমর্পণ ও ত্যাগ।
হজ পালনের শেষ দিনে কুরবানি করা ওয়াজিব হয় হাজিদের ওপর।
ঈদুল আজহা কুরবানির মাধ্যমে হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে স্মরণ করে।
হজ্ব ও কুরবানি মুসলমানদের জীবনে আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ, সংযম ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এ দু’টি ইবাদতের গভীর প্রভাব রয়েছে। আমাদের উচিত যথাযথভাবে এই ইবাদত পালনের চেষ্টা করা এবং এর শিক্ষা বাস্তব জীবন
হজ্ব ও কুরবানির শিক্ষা—আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগের চেতনা-
জিলহজ মাসের আগমন মুসলিম সমাজে একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে আসে। এই মাসে পালিত হয় ইসলামের দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত—হজ্ব ও কুরবানি। এগুলোর বাইরের আনুষ্ঠানিকতা যত গুরুত্বপূর্ণ, এর ভেতরের শিক্ষা ও আত্মিক তাৎপর্য আরও বেশি গভীর এবং সময়োপযোগী।
হজ্ব: এক মহাসম্মেলন ও আত্মশুদ্ধির অভিযান
হজ্ব কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়; এটি একটি সর্বজনীন আহ্বান, যে আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বজুড়ে কোটি মুসলমান নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র মক্কায় সমবেত হন। তারা জাতি, বর্ণ, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থান ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে নিবেদন করেন। হজ্ব আমাদের শিখিয়ে দেয়, সত্যিকারের মুসলিম ঐক্য কীভাবে গড়ে ওঠে আত্মবিলীনতা, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে।
এটি একটি আত্মিক সফর, যেখানে মানুষ নিজের অহংকার, দুনিয়াবি মোহ ও গুনাহর বোঝা ঝেড়ে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করার সংকল্প করে। আধুনিক সমাজে যেখানে আত্মমর্যাদার নামে ব্যক্তি স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে হজ্ব আমাদের শেখায়—আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি সম্ভব।
কুরবানি: ত্যাগের এক সর্বজনীন পাঠ
ইব্রাহিম (আ.) এর ঐতিহাসিক ত্যাগের স্মরণে যে কুরবানি মুসলিমরা দেন, তা কেবল পশু জবাইয়ের একটি ধর্মীয় রীতিই নয়। বরং এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা হলো—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার মানসিকতা গড়ে তোলা। আমাদের জীবনেও রয়েছে অনেক “ইসমাঈল”, যেগুলো হয়তো আমাদের অহংকার, ভোগবিলাস, অবৈধ চাহিদা বা স্বার্থপরতা—যেগুলো কুরবানি না করলে আত্মশুদ্ধি অসম্ভব।
আজকের বৈষয়িক সমাজে কুরবানির চেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়: মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন আত্মত্যাগ, সহানুভূতি ও দানশীলতার মধ্য দিয়েই সম্ভব।
সময়োপযোগী প্রাসঙ্গিকতা
আজ যখন বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহ বিভাজন, সংকট ও আত্মঘাতী সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন হজ্ব ও কুরবানির চেতনা হতে পারে আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক। ব্যক্তি থেকে সমাজ—সর্বত্র দরকার আত্মনিয়ন্ত্রণ, ত্যাগ ও ঐক্যের চর্চা।